টেসলা, অটোমোবাইলস এবং প্রযুক্তি এক হয় যেখানে।

টেসলা। অটো-পাইলট সিস্টেমের গাড়ির কথা বললে, কিংবা ইলেকট্রিক গাড়ির নাম শুনলেই সবার প্রথমে আপনার মাথায় আসবে টেসলার নাম। সেই গতানুগতিক পরিচয়টা ছাড়াও বিএমডব্লিউ, মার্সেডিজ, কিংবা অডির পাশাপাশি লাক্সারি কার হিসেবেও এখন টেসলার নাম উচ্চারণ হয়। এই শতকে বসেই ভবিষ্যৎ অনুভব করানো টেসলাকে নিয়ে আজ থাকছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য। দেরি কেন। চলুন, শুরু করা যাক।


বিশ্বব্যাপী অটোমোবাইল জগত ক্রমশই পরিবর্তন হচ্ছে । বাজারের অধিকাংশ মোটরযান ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। ফলে তৈরি হয় প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অযাচিত তাপ। যার কোনটাই আমাদের এই পৃথিবীর জন্য ভালো নয়। তাছাড়া জ্বালানির যে মজুদ, তা দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। 

যেভাবে শুরু

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় টেসলা মোটরস এর। তড়িৎ বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার প্রতি সম্মান রেখেই এই নামকরণ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই টেসলার মূল প্রতিপাদ্য নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বিদ্যুৎের সাহায্যে বাজার উপযোগী গাড়ি তৈরি। টেসলার মূল প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন এবারহার্ড এবং মার্ক টার্পেনিং। পরবর্তীতে বিনিয়োগকারী হিসেবে যোগ দেন ইলন মাস্ক। ইলনের ব্যবসায়ক তুখোড় বুদ্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্তে আর পিছনে ফিরতে হয়নি টেসলাকে।


টেসলাম প্রথম মডেল ছিলো টেসলা রোডস্টার। যার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ এ। ইলনের ব্যবসায়ক স্ট্রাটেজিটা ছিলো বেশ চমৎকার। এর নাম দিয়েছিলেন তিনি সিক্রেট মাষ্টারপ্লান। ইলন চেয়েছিলেন প্রথমে তিনি লাক্সারি মডেল তৈরি করবেন। শুধু ধনকুবেরদের জন্য। সেই মডেলের লাভ দিয়ে তিনি পরের মডেল আরেকটু কম মূল্যের ভিতরে তৈরি করবেন। এভাবে ধীরে ধীরে টেসলাকে সবার হাতে পৌছে দেবার মতো গাড়ি হিসেবে তৈরি করবেন তিনি। 


এরই ধারাবাহিকতায় রোডষ্টারের পরে বাজারে আসে  টেসলা মডেল এস। ২০১২ তে আসা এই গাড়িটি ছিলো অনেকটাই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। ৭৬ হাজার ডলারের এই গাড়িটি প্রায় ২৪৯ কি.মি/ ঘন্টা বেগে ছুটতে পারে। এর পরে আসতে থাকে মডেল এক্স, মডেল ওয়াই। মডেল ওয়াই মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার ভিতরে থাকায় দারুন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। টেসলার সর্বশেষ সংযোজন সাইবার ট্রাক। ভবিষ্যৎ থেকে উঠে আসা গাড়িটি একই সাথে টেকনোলজি ও অটোমোবাইল ইন্ড্রাষ্ট্রির জন্য এক মাইলফলক।

এক নজরে সব মডেল

টেসলা রোডস্টার।

২০০৮ এ প্রথম বাজারে আসে রোডস্টার। প্রথম টেসলা গাড়ি এটি। বলা যায় প্রথম শক্তিশালী ইলেকট্রিক সুপারকারও টেসলা রোডস্টার।  একবার চার্জে গাড়িটি প্রায় ৪০০ কি.মি যেতে পারে। শূণ্য থেকে ১০০ কি.মি/ঘন্টা বেগ উঠতে গাড়িটি সময় নেয় মাত্র ৩.৯ সেকেন্ড। টেসলার পথচলার শুরু এখানেই। সাথে সফলতার।

টেসলা মডেল এস।

২০১২ তে প্রথম বাজারে আসে মডেল এস। রোডস্টার ছিলো স্পোর্টসকার। কিন্ত মডেল এস ছিলো বাজারের অন্য গাড়িগুলোর মতোই।  তাছাড়া দামের দিকেও বেশ সাশ্রয়ী ছিলো মডেল এস। গাড়িটি ১০২০ হর্সপাওয়ার জেনারেট করতে পারে। এবং ০ থেকে ৬০ মাইল/ঘন্টায় স্পিড তুলতে পারে মাত্র ১.৯৯ সেকেন্ডে। সর্বোচ্চ স্পিড জেনারেট করতে পারে প্রায় ৩২১ কি.মি/ ঘন্টা বেগে। একবার চার্জে গাড়িটি প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। এটি ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য একটি রেকর্ড।

টেসলা মডেল এক্স।

মডেল এক্স ২০১৫ এ বাজারে আসা একটি এসইউভি। প্রতিবার চার্জে এটি যেতে পারে প্রায় ৫৩৫ কি.মি। এই গাড়ির সবচেয় আকর্ষণীয় ছিলো এর দরজাগুলি। সাধারণত গাড়ির দরজা পাশে কিংবা উপরে খোলে। কিন্ত মডেল এক্স এর দরজা খোলে আড়াআড়িভাবে উপরে। যা পরিচিত ফ্যালকন উইংস হিসেবে। মডেল এক্স ১০২০ হর্সপাওয়ার তৈরি করতে সক্ষম।

টেসলা মডেল থ্রি।

 ২০১৭ এ বাজারে আসে মডেল থ্রি সেডানটি। মডেল থ্রির দাম ধরা হয় ৩২ হাজার ডলার। এই সুলভ মূল্যের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে মডেল থ্রি। মডেল থ্রি সর্বোচ্চ ২৬০ কি.মি/ ঘন্টায় ছুটতে সক্ষম। তবে মডেল থ্রির অটোপাইলট সিস্টেম চমকপ্রদ।

টেসলা মডেল ওয়াই।

লেটেস্ট টেসলা মডেল এটাই। ২০২০ এ বাজারে আসে মডেল ওয়াই। এটি মোটামোটি বড়সড় এসইউভি। গাড়িটির কার্গোস্পেস প্রায় ৭০ কিউবিক ফুট। এক চার্জে প্রায় ৫০০ কিমি চলতে পারে। গাড়িটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিমি। বর্তমানে ৪২ হাজার ডলারেই গাড়িটি পাওয়া যায়। 

টেসলা সাইবারট্রাক।

এ যাবতকালে সবচেয়ে আলোচিত গাড়ি টেসলা সাইবার ট্রাক। কয়েক বছর আগে সামনে আনা হলেও এখনও বড় পরিসরে বাজারজাত শুরু হয়নি সাইবার ট্রাকের। মোটামোটি এলিয়েনদের সাথে যুদ্ধ করবার মতো একটা সেমি লাইট ট্রাক সাইবার ট্রাক। চমৎকার ম্যাটেরিয়াল, ফিউচারিষ্টিক ডিজাইন আর প্রযুক্তির সর্বোচ্চ মেল বন্ধন নিয়ে বিশ্বের গাড়ি ও প্রযুক্তিপ্রেমীদের এখন নজর কবে বাজারে আসবে সাইবার ট্রাক। ইলন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০২৩ এর মাঝ দিয়ে হয়তো আসতে পারে সাইবার ট্রাক। সেই অপেক্ষাতেই আছে বিশ্ববাসী।


আরো পড়ুন:

কিভাবে কাজ করে অটোপাইলট?

অটোপাইলট শুনতেই একটা বিমানের ফিল তৈরি হয়। গাড়িতে অটোপাইলটের সূচনা বেশিদিন আগে নয়। তবে এর পথপ্রদর্শক প্রায় পুরোটাই টেসলা। টেসলার গাড়িগুলো চালক ছাড়াই একা একা কোন গন্তব্যে পৌছাতে পারে। 

টেসলার অটোপাইলট সিস্টেমে কাজ করে গাড়ির রাডার, অনেকগুলো ক্যামেরা, চমৎকার একটা ব্রেকিং সিস্টেম এবং প্রায় ১২ টা আল্ট্রাসনিক সেন্সর। টেসলা একা একা লেন চেন্জ করতে পারে। একা একা ভিতরের তাপমাত্রা নিয়ণ্ত্রণ করতেও সক্ষম।  প্রথমে টেসলা ম্যাপে তার গন্তব্য দেখে নেয়। এরপর স্যাটেলাইটের সাহায্যে সহজতম পথটি বেছে নেয়। ক্যামেরাগুলি রাস্তার অবস্থা, সামনের গাড়ির গতি, রোড সাইন, স্পিড লিমিট সবকিছুকে আমলে নিয়ে গাড়িকে চলতে সাহায্য করে। আর আল্ট্রাসনিক সেন্সরগুলো যেকোন স্পিডে গাড়ির  চারপাশের ১৬ ফিটের ভিতের থাকা যেকোন কিছুকে অনুভব করতে পারে এবং সে অনুযায়ী সিস্টেমকে তথ্য দিয়ে গাড়ি পরিচালনায় সাহায্য করে। 


এভাবেই বিভিন্ন সেন্সর, ক্যামেরা আর রাডারের মাধ্যমে টেসলা অটোপাইলট কাজ করে।

চার্জ কিভাবে হয় টেসলা?

টেসলার সাথেই চার্জিং কেবল দেওয়া হয়। আপনি বাড়িতে বসেই আপনার গ্যারেজে টেসলা চার্জ করতে পারবেন। বাড়িতে বসে একবার পুরোপুরি খালি ব্যাটারি ফুল চার্জ হতে টেসলা সময় নেয় দশ থেকে ১২ ঘন্টা। টেসলা সুপার চার্জিং স্টেশনে ১৫ মিনিটেই প্রায় ২০০ কি.মি যাওয়ার মতো চার্জ করা সম্ভব হয়। তবে সুপার চার্জিং এ কিছুটা খরচ বেশি পড়ে। সাধারণত টেসলায় প্রতি কিমি যেতে মাত্র ৫ টাকা খরচ হয়। 

বাংলাদেশে টেসলা।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটা টেসলা গাড়ি আছে। যদিও বাংলাদেশে অটোপাইলট টেকনোলজি ততটা কাজে লাগে না। তবুও অনেকেই শখের বশে টেসলা কিনছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে প্রায় সব গাড়ির ওপরেই অতিরিক্ত করারোপ করা হয়। কিছু গাড়ির ক্ষেত্রে সেটা ৫০০% ও হয়ে যায়। তবে টেসলাসহ বৈদ্যুতিক গাড়িতে কর ১০০% এর কাছাকাছি। ফলে অন্যান্য বিলাসবহুল গাড়ির চেয়ে টেসলার দাম কিছুটা কম বাংলাদেশে। কিন্ত পরিবেশের বন্ধু হিসেবে এই ধরনের গাড়ির আমদানি বাড়ানো ও করের হার কমানো যুক্তি সঙ্গত।

জানেন কি?

টেসলাতে কোন ইন্জিন থাকে না। মোটরের মাধ্যমে টেসলা তার চাকাগুলোতে শক্তি দেয়।

সাধারণ ফোন বা কম্পিউটারের মতো টেসলাও আপডেট নেয়।

কোন স্থানে টেসলা চালানোর সময় টেসলা তার সেন্সরে আশে পাশে মানুষ হাটছে এমনটা শো করে। (https://www.youtube.com/watch?v=YQuSEjrUjqU)

টেসলার সেন্সর কুকুর, পাখি বা অন্য পশুও ডিটক্টে করতে পারে।


দ্রুত শেষ হয়ে যাবে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ। তাছাড়া সাধারণ গাড়ি পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকরও বটে। কিন্ত টেসলা পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। তাই দিন দিন বেড়েই চলছে টেসলার চাহিদা। চমৎকার অটোপাইলট সিস্টেম, নজরকাড়া ডিজাইন, কম খরচের জন্য মানুষ দিন দিন ঝুকছে টেসলার প্রতি। টেসলার বর্তমান মার্কেটে দখল প্রায় ১৬ শতাংশ। খুব দ্রুতই এই সংখ্যা আরো বাড়বে। আরো উন্নত হবে প্রযুক্তি, আসবে আরো অনেক ইলেকট্রিক গাড়িও, তবে, আগামীর গাড়ির ও প্রযুক্তির বাজারে হয়তো রাজত্ব করবে ইলন মাস্কের টেসলা আইএনসি।






শেখ সাদি বিন সাঈদ

আর্টিকেল রাইটার

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url